দাদা-বৌদি বিরিয়ানি: এক অদ্ভুত প্রেমের স্বাদ
কলকাতার মানুষ বিরিয়ানি ভালোবাসে, এটা নতুন কিছু নয়। তবে কিছু বিরিয়ানি শুধু স্বাদের জন্য নয়, গল্পের জন্যও বিখ্যাত হয়। আজ বলব এমনই এক বিরিয়ানির গল্প, যার নাম "দাদা-বৌদি বিরিয়ানি"। উত্তর কলকাতার ছোট্ট একটি দোকান থেকে শুরু হওয়া এই বিরিয়ানির যাত্রা আজ গোটা শহরের মানুষের মুখে মুখে। কী আছে এই বিরিয়ানিতে? কেনই বা এত বিখ্যাত? চলুন, জেনে নিই এই বিশেষ বিরিয়ানির পিছনের কাহিনি।
শুরুর গল্প: কোথা থেকে এল এই নাম?
কলকাতার যেকোনো বিখ্যাত খাবারের পেছনে একটা মজার গল্প লুকিয়ে থাকে। "দাদা-বৌদি বিরিয়ানি"র ইতিহাসও তেমনই আকর্ষণীয়। আসানসোলের কাছে এক ছোট্ট জায়গায় ১৯৭০-এর দশকে এক দম্পতি এই দোকান শুরু করেন। এলাকার মানুষ তাঁদের "দাদা" ও "বৌদি" বলে ডাকত। তাঁদের মধ্যে যে ভালোবাসা, সহযোগিতা ও আন্তরিকতা ছিল, তা তাঁদের রান্নাতেও ফুটে উঠত।
সেই সময় বড় বড় রেস্তোরাঁগুলোর পাশে ছোট দোকান তেমন জনপ্রিয় ছিল না। কিন্তু দাদা ও বৌদির বিরিয়ানির স্বাদ এতটাই অনন্য ছিল যে, মুখে মুখে সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে এই দোকান "দাদা-বৌদি বিরিয়ানি" নামেই পরিচিত হয়ে গেল।
দাদা-বৌদি বিরিয়ানির স্বাদ: কী আছে এতে?
কলকাতার বিরিয়ানি মানেই সুগন্ধি বাসমতি চাল, বড় আলু, নরম মাংস আর হালকা মশলার ছোঁয়া। তবে দাদা-বৌদি বিরিয়ানির বিশেষত্ব অন্য জায়গায়।
১. ঘরে তৈরি মশলা: এই বিরিয়ানির আসল জাদু লুকিয়ে আছে তাদের নিজস্ব মশলার মিশ্রণে। এটি কোনো সাধারণ গারম মসলা নয়, বরং নিজেদের তৈরি বিশেষ মশলা, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ব্যবহার হচ্ছে।
2. গোল্ডেন আলু: কলকাতার বিরিয়ানিতে আলু থাকা বাধ্যতামূলক। দাদা-বৌদি বিরিয়ানির আলু একেবারে স্বর্ণালী রঙের হয়, যা আলাদা করে চোখে পড়ে। এটি ভাজা হয় ঘি ও কেশরের হালকা সংমিশ্রণে, ফলে স্বাদে আসে অতুলনীয়তা।
৩. মাংসের বিশেষ কাট: সাধারণত বিরিয়ানির জন্য বড় মাংসের টুকরো ব্যবহৃত হয়, কিন্তু এখানে ব্যবহৃত হয় নির্দিষ্ট অংশের মাংস, যা চর্বি ও নরম মাংসের সঠিক অনুপাত বজায় রাখে।
৪. হালকা অথচ গভীর স্বাদ: এই বিরিয়ানির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, এটি তেল-মশলার ভারে ভারাক্রান্ত নয়। কিন্তু খেতে গেলে প্রতিটি কামড়ে মশলার গভীরতা টের পাওয়া যায়।
প্রেম, সম্পর্ক ও বিরিয়ানি
এই দোকানটি কেবল খাবারের জন্য বিখ্যাত নয়, দাদা-বৌদির সম্পর্কের জন্যও এটি জনপ্রিয়। তাঁদের মধ্যে যে বোঝাপড়া, ভালোবাসা, এবং পরিশ্রমের সমন্বয় তা আজও দোকানের প্রতিটি কোণায় টের পাওয়া যায়। অনেক দম্পতি এখানে এসে গল্প করেন, নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন, কারণ এই বিরিয়ানি যেন প্রেমের এক অনন্য প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বিরিয়ানির পাগল ভক্তরা
দাদা-বৌদি বিরিয়ানির জন্য ভক্তদের কোনো অভাব নেই। অনেকেই বলেন, কলকাতার নামকরা বিরিয়ানির দোকানগুলোর থেকে এখানকার বিরিয়ানির স্বাদ আলাদা। কেউ কেউ আবার দাবি করেন, একবার খেলে অন্য বিরিয়ানি আর খেতে ইচ্ছে করবে না।
যেমন সুমনদা, যিনি প্রতি রবিবার এখানে আসেন। তিনি বলেন,
"কলকাতায় অনেক বিরিয়ানি খেয়েছি, কিন্তু দাদা-বৌদি বিরিয়ানির মতো স্বাদ আর কোথাও পাইনি। এখানে এলে মনে হয় বাড়ির খাবার খাচ্ছি।"
আরেকজন নিয়মিত গ্রাহক, রিমি দাস বলেন,
"আমার স্বামী আর আমি এখানে প্রথম এসেছিলাম আমাদের বিয়ের পর। সেই থেকে প্রতি মাসে অন্তত একবার আমরা এখানে আসি। এই দোকানের গল্প আমাদের ভালোবাসার গল্পের সঙ্গেও মিশে গেছে।"
কোথায় পাবেন এই স্বাদ?
দাদা-বৌদি বিরিয়ানি পাওয়া যায় আসানসোল, দুর্গাপুর ও কিছু নির্দিষ্ট জায়গায়। তবে আসল স্বাদ পেতে হলে আপনাকে আসানসোলের মূল দোকানেই যেতে হবে।
এখানে শুধুমাত্র বিরিয়ানি নয়, কাবাব, চিকেন চপ, এবং কাশ্মীরি রগান জোশও পাওয়া যায়, যা বিরিয়ানির সঙ্গে খেতে বেশ ভালো লাগে।
এক টুকরো নস্টালজিয়া
বিরিয়ানি শুধু খাবার নয়, এটি এক টুকরো স্মৃতি। দাদা-বৌদি বিরিয়ানি কেবল স্বাদের জন্য নয়, সম্পর্ক, ভালোবাসা, ও পরিশ্রমের কাহিনির জন্যও বিখ্যাত।
এই দোকানটি প্রমাণ করে যে, ভালোবাসা আর নিষ্ঠা থাকলে ছোট জিনিসও বড় হয়ে উঠতে পারে। তাই যদি কখনো আসানসোলে যান, তাহলে এক প্লেট দাদা-বৌদি বিরিয়ানি খেয়ে আসতেই হবে। আপনি একবার খেলেই বুঝতে পারবেন, কেন এই বিরিয়ানি এত স্পেশাল!
আপনার প্রিয়
বিরিয়ানির দোকান কোনটি? কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না!
0 Comments